ষাটের দশকে এহতেশাম, মুস্তাফিজ, ফজলে দোসানী, আনিস দোসানীর মতো পরিচালকরা উর্দু ভাষায় ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মালা’, ‘সংগম’, ‘তানহা’, ‘বাহানা’, ‘চকোরী’র মতো সিনেমা নির্মাণ করে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙা করার চেষ্টা করেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ঢাকায় ১৪টি বাংলা সিনেমার বিপরীতে ১৮টি উর্দু সিনেমা নির্মিত হয়, যা বাংলা সিনেমার দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এই সংকটের মধ্যে সালাহউদ্দিন বাংলা সিনেমার দর্শকদের ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজতে থাকেন এবং ‘রূপবান’ যাত্রাপালার জনপ্রিয়তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এটিকে সিনেমার পর্দায় তুলে আনার সিদ্ধান্ত নেন।
পূর্ব পাকিস্তানে তখন ‘রূপবান’ যাত্রাপালার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। এক গ্রামে সারারাত জেগে এই পালা দেখার পর সালাহউদ্দিন উপলব্ধি করেন, গল্পের মাটির গন্ধ, নাটকীয়তা এবং হৃদয়গ্রাহী লোকসংগীতই দর্শকদের এতোটা আকৃষ্ট করেছে। তিনি ঝুঁকি নিয়ে এই লোকগাথাটিকে সিনেমায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেন, যদিও অনেকে তখন এই উদ্যোগ নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন। সংশয় সত্ত্বেও সালাহউদ্দিন দেড় লাখ রুপির বাজেটে ‘রূপবান’ নির্মাণ শুরু করেন।
যাত্রাপালার অতিনাটকীয় উপাদানগুলো বাদ দিয়ে সহজ-সরল চিত্রনাট্য ও সংলাপের মাধ্যমে লোকজ ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রদর্শনের জন্য সিনেমাটি বাংলা ও উর্দু দুই ভাষায় নির্মিত হয়, যা এটিকে দেশের প্রথম দ্বিভাষিক সিনেমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রতিটি শট বাংলা ও উর্দু সংলাপে দুইবার শুট করা হতো।
১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর ‘রূপবান’ মুক্তি পায় এবং মফস্বলের প্রেক্ষাগৃহে অভূতপূর্ব দর্শক সমাগম ঘটে। গ্রামের মানুষ নৌকা, গরুর গাড়ি কিংবা পায়ে হেঁটে প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যান। নায়িকা সুজাতা আজিমের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে, তাকে জনতার ভিড় থেকে রক্ষায় পুলিশ মোতায়েন করতে হয়। অনেকে টিকিট না পেয়ে রাতভর প্রেক্ষাগৃহে অপেক্ষা করে পরের দিন সিনেমা দেখেছেন। প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা দর্শকদের জন্য খিচুড়ি রান্না ও রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
‘রূপবান’র গল্পে ১২ বছরের রূপবানের সঙ্গে সদ্যোজাত রাজপুত্র রহিমের বিয়ে, দৈববাণীতে বনবাস, রহিমের বেড়ে ওঠা, রাজকন্যা তাজেলের প্রেম এবং অমোঘ সত্যের প্রকাশ ঘটে। সুজাতা আজিম ছাড়াও মনসুর, চন্দনা, আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, তেজেন চক্রবর্তী, তন্দ্রা, রহিমা ও হেলেন অভিনয় করেন। ‘শোনো তাজেল গো’, ‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো’, ‘সাগর ক‚লের নাইয়ারে’র মতো গানগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, ইসমত আরা, কুসুম হক, নজমুল হোসেন (শেলী)। সংগীত পরিচালনা করেন সত্য সাহা এবং গানের কথা লেখেন মাসুদ করিম।
সিনেমাটির বাণিজ্যিক সাফল্য অতীতের সব রেকর্ড ভাঙে। ১৭টি প্রিন্ট নিয়ে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা গ্রামে মৌসুমী প্রেক্ষাগৃহ তৈরির প্রেরণা জোগায়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে ভারতীয় সিনেমা আমদানি বন্ধ হওয়ায় ‘রূপবান’ দর্শকদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হয়। এটি বাংলা সিনেমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করে এবং সিনে-সাংবাদিকরা এই সময়কে ‘রূপবান যুগ’ হিসেবে অভিহিত করেন।