Saturday, August 16, 2025

‘তেহরান’: ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের ছায়ায় জন আব্রাহামের রোমাঞ্চকর থ্রিলার

 ইরান ও ইসরায়েল—ভারতের দুই মিত্র দেশ। একদিকে ইরান থেকে তেল আমদানি, অন্যদিকে ইসরায়েল থেকে প্রযুক্তি। কিন্তু এই দুই দেশ যখন দ্বন্দ্বে জড়ায়, তখন ভারত কার পক্ষ নেবে, নাকি নীরব থাকবে? এই জটিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধূসর জগতে আলো ফেলেছে পরিচালক অরুণ গোপালনের থ্রিলার সিনেমা ‘তেহরান’। জন আব্রাহাম অভিনীত এই সিনেমা দর্শকদের নিয়ে যায় নৈতিকতা ও বাস্তবতার সূক্ষ্ম সীমারেখায়, যেখানে রাজনৈতিক ও মানবিক গল্পের এক অনন্য উপাখ্যান তৈরি হয়েছে।

‘তেহরান’-এর গল্প ২০১২ সালে নয়াদিল্লিতে ইসরায়েলি কূটনীতিকের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। একই দিনে জর্জিয়া ও থাইল্যান্ডেও একই ধরনের হামলা হয়েছিল। ইসরায়েল তখন এর পেছনে ইরানের হাত সন্দেহ করেছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে সিনেমার গল্প।

সিনেমার নায়ক এসিপি রাজীব কুমার (জন আব্রাহাম) দিল্লি পুলিশের বিশেষ ইউনিটের নেতৃত্ব দেন। হামলার মূল উৎস খুঁজে বের করাই তার লক্ষ্য। প্রথমে তিনি তদন্ত নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু এক পথশিশুর মৃত্যু তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ফুল বিক্রি করা মেয়েটির মৃত্যু হাসপাতালে তার চোখের সামনে হয়, যার ছোট ভাইয়ের ফ্যাকাশে চোখ রাজীবের মনকে মুচড়ে দেয়। এরপর শুরু হয় তার তদন্ত। তিনি বুঝতে পারেন, হামলার পেছনে সামরিক বাহিনীর যোগসাজশ রয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, ইসরায়েল ইরানের পরমাণু বিশেষজ্ঞদের হত্যা করেছিল, আর এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরায়েলি কূটনীতিকদের ওপর হামলা চালায়।

তদন্তের গভীরে গিয়ে রাজীব বুঝতে পারেন, এই ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে। কিন্তু যখনই তিনি মূল উৎপাটনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে নামেন, তখনই তাকে তদন্ত থামিয়ে ফিরতে বলা হয়। কারণ, ভারত শিগগিরই ইরানের সঙ্গে তেল চুক্তি করতে যাচ্ছে এবং এই সময়ে ইরানকে অপরাধী হিসেবে সামনে আনলে কূটনৈতিক অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। কিন্তু বেপরোয়া ও খ্যাপাটে রাজীব কি সরকারের নির্দেশ মানবেন?

কিছু খামতি থাকলেও ‘তেহরান’ একটি উপভোগ্য সিনেমা। এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো বাস্তবঘেঁষা নির্মাণ। পরিচালক অরুণ গোপালন বাণিজ্যিক উপাদান মিশিয়ে মচমচে থ্রিলার বানাননি, বরং দর্শকের ভাবনাকে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিনেমায় গান নেই, গ্ল্যামার নেই, নায়কোচিত বাড়াবাড়ি নেই। অ্যাকশন, ধাওয়া ও রোমান্স আছে, তবে তা গল্পকে ছাপিয়ে যায়নি। চরিত্রগুলোর নৈতিক দ্বন্দ্ব ও মানবিক প্রশ্ন সিনেমাটিকে ভিন্ন মেজাজ দিয়েছে।

অনেক হিন্দি সিনেমায় আন্তর্জাতিক ঘটনা শুধু পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘তেহরান’ এর ব্যতিক্রম। পরিচালক অরুণ গোপালন এবং লেখক রিতেশ শাহ, বিন্দি কারিয়া ও আশিষ প্রকাশ ভার্মা গল্পে ভারসাম্য রেখেছেন। ভারতের স্পাই থ্রিলারে সাধারণত পাকিস্তান প্রসঙ্গ উঠে আসে, কিন্তু এই সিনেমা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দর্শকদের নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছে। ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান, ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ বাস্তবভাবে ফুটে উঠেছে।

জন আব্রাহাম পুরোপুরি বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি ভিন্নধারার কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী চরিত্রে তিনি দারুণ মানানসই। আবেগের দৃশ্যে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও, মানবিক ও বেপরোয়া পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে তিনি দুর্দান্ত। তার পূর্ববর্তী কাজ ‘মাদ্রাজ ক্যাফে’, ‘বাতলা হাউস’ ও ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এর অভিজ্ঞতা এখানেও প্রতিফলিত হয়েছে।

অন্যান্য অভিনেতারাও যথাযথ। তবে রাজীবের সহকর্মী বিদ্যা চরিত্রে মানুষি ছিল্লারের উপস্থিতি বোধগম্য নয়, কারণ চিত্রনাট্যে তার জন্য তেমন কিছু করার জায়গা ছিল না। এদিকে আরএডব্লিউ প্রধান হিমাদ্রির চরিত্রে বাঙালি নির্মাতা কৌশিক মুখার্জি (কিউ) দারুণ চমক দিয়েছেন। এর আগে দক্ষিণী সিনেমায় তাকে খলনায়ক হিসেবে দেখা গেলেও এই সিনেমা তার জন্য নতুন সম্ভাবনা খুলে দিতে পারে।

চিত্রগ্রাহক ইভজেনি গুব্রেঙ্কো ও আন্দ্রে মেনেজেসের ক্যামেরার কাজ সিনেমার গুরুগম্ভীর মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। কেমন সৌধর আবহসংগীতও চলনসই। ইরান সরকার ও বিদ্রোহী সেনাদের দ্বন্দ্ব, ফিলিস্তিন সমর্থন, মোসাদের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাজ—সব মিলিয়ে সিনেমাটি বিশ্ব রাজনীতির জানা-অজানা অধ্যায় তুলে ধরেছে।

তিন বছর নির্মাণের পর ‘তেহরান’ প্রেক্ষাগৃহে নয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি৫-এ মুক্তি পেয়েছে। ফারসি সংলাপের বড় অংশ সাধারণ হিন্দি দর্শকদের জন্য সহজবোধ্য নাও হতে পারে, যা হয়তো নির্মাতারা সচেতনভাবেই বিবেচনা করেছেন। তবুও এটি একটি ভিন্নধর্মী, চিন্তাশীল ও রোমাঞ্চকর স্পাই থ্রিলার, যা দর্শকদের মনে দাগ কাটবে।


Share This Post

শেয়ার করুন

Author:

Note For Readers: The CEO handles all legal and staff issues. Claiming human help before the first hearing isn't part of our rules. Our system uses humans and AI, including freelance journalists, editors, and reporters. The CEO can confirm if your issue involves a person or AI.