Saturday, August 23, 2025

ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীনের ফিরে আসা: সংগীত ও রাজনীতির মাঝে এক সাধকের পথচলা

বাংলাদেশের সংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামে খ্যাত, বেবী নাজনীন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শ্রোতাদের হৃদয়ে রাজত্ব করেছেন তাঁর সুরেলা কণ্ঠে। তবে কয়েক বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গন থেকে অনেকটা দূরে ছিলেন। মাঝেমধ্যে নতুন গান প্রকাশ করলেও বিনোদন জগতের কোনো আড্ডায় তাঁর উপস্থিতি ছিল না। শ্রোতারা তাঁর গানের মতোই তাঁকে খুঁজে বেড়াতেন। অবশেষে, গত বছর দেশে ফিরে এসে তিনি আবারও মঞ্চে ফিরছেন, শ্রোতাদের মুগ্ধ করছেন তাঁর অমর গানের জাদুতে।

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থাকার পর গত বছরের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন বেবী নাজনীন। রাজনীতি ও সংগীতচর্চা—দুটোই এখন তাঁর জীবনে সমানতালে চলছে। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। সেই যাত্রা অব্যাহত ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর মঞ্চে গান কমতে শুরু করে, প্রধানত তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো মঞ্চে তাঁকে দেখা যায়নি। তবে দেশের মঞ্চে গাইতে না পারলেও ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন মঞ্চে তিনি তাঁর সংগীতের জাদু ছড়িয়েছেন। গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে ফিরে তিনি আবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইছেন।

বেবী নাজনীনের সংগীতের হাতেখড়ি তাঁর বাবা মনসুর সরকারের কাছে। এরপর নিজের সাধনা ও প্রতিভায় তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন। এহতেশামের ‘লাগাম’ সিনেমার গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন আজাদ রহমান। ১৯৮৭ সালে মকসুদ জামিল মিন্টুর সংগীত পরিচালনায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’। এই অ্যালবাম তাঁর সংগীত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

১৯৬৫ সালের ২৩ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন বেবী নাজনীন। আজ তাঁর জন্মদিন বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিবারের সঙ্গে সাদামাটাভাবে কাটছে। কোনো জমকালো আয়োজন বা হইহুল্লোড় তিনি পছন্দ করেন না। তাঁর মতে, “সাদামাটা জীবনই বেশি সুন্দর।”

ষাটের দশকের মাঝামাঝি জন্ম নেওয়া বেবী নাজনীন একসময় বাংলাদেশের সংগীত জগতের অপরিহার্য নাম হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’র পর ‘নিঃশব্দ সুর’, ‘কাল সারা রাত’, ‘প্রেম করিলেও দায়’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না’—এই অ্যালবামগুলো তাঁর অবস্থান আরও শক্ত করে। ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনের রাত’, ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না তোমাকে দেখার পর’, ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল রে মরার কোকিলে’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘কই গেলা নিঠুর বন্ধু রে সারা বাংলা খুঁজি তোমারে’—এমন অসংখ্য গান আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন’।

২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন বেবী নাজনীন। এছাড়াও সিজেএফবি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা তাঁর ঝুলিতে রয়েছে। তিনি আধুনিক সংগীতের সর্বাধিক সংখ্যক একক, দ্বৈত ও মিশ্র অডিও অ্যালবামের শিল্পী। সংগীত জীবনের শুরু থেকেই তিনি অডিও, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও দেশ–বিদেশের মঞ্চ মাতিয়ে চলেছেন।

দীর্ঘদিন নতুন গানে না থাকার বিষয়ে বেবী নাজনীন হতাশা প্রকাশ করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, “নতুন গানের কাজ চলছে। তবে একটু সময় লাগবে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। গান একটি সংবেদনশীল বিষয়, যা মানুষের মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। শিল্পীদের জন্য দেশের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও বলেন, “পৃথিবীর উন্নত দেশে শিল্পীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়ে না। কাউকে ব্ল্যাক লিস্ট করা বা বাদ দেওয়ার মতো হীনমন্যতা সেখানে নেই।”

প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেবী নাজনীন বলেন, “শিল্পীর জায়গায় শিল্পী, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। কোনো শিল্পীর উচিত নয় রাজনৈতিক প্রভাব সংস্কৃতিতে খাটানো। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে মূল্যায়িত হবে। রাজনীতিতে যোগ দিলেও এমন কিছু করা উচিত নয়, যা শিল্পী–জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সংস্কৃতিতে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া মানে দেশের অবকাঠামো ধ্বংস করা।”

বেবী নাজনীনের ফিরে আসা বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি আবারও শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন, এবং তাঁর এই পুনরাগমন দেশের সংগীত জগতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করছে।


Share This Post

শেয়ার করুন

Author:

Note For Readers: The CEO handles all legal and staff issues. Claiming human help before the first hearing isn't part of our rules. Our system uses humans and AI, including freelance journalists, editors, and reporters. The CEO can confirm if your issue involves a person or AI.